বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫

কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ

কর্ণ ।       পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার

        বন্দনায় আছি রত । কর্ণ নাম যার

        অধিরথসূতপুত্র , রাধাগর্ভজাত

        সেই আমি কহো মোরে তুমি কে গো মাতঃ!

কুন্তী ।       বৎস , তোর জীবনের প্রথম প্রভাতে

        পরিচয় করায়েছি তোরে বিশ্ব-সাথে

        সেই আমি , আসিয়াছি ছাড়ি সর্ব লাজ

        তোরে দিতে আপনার পরিচয় আজ ।

 কর্ণ ।       দেবী , তব নতনেত্রকিরণসম্পাতে

        চিত্ত বিগলিত মোর , সূর্যকরঘাতে

        শৈলতুষারের মতো । তব কণ্ঠস্বর

        যেন পূর্বজন্ম হতে পশি কর্ণ-'পর

        জাগাইছে অপূর্ব বেদনা । কহো মোরে

        জন্ম মোর বাঁধা আছে কী রহস্য-ডোরে

        তোমা সাথে হে অপরিচিতা!

কুন্তী ।                          ধৈর্য ধর্ ,

        ওরে বৎস , ক্ষণকাল । দেব দিবাকর

        আগে যাক অস্তাচলে । সন্ধ্যার তিমির

        আসুক নিবিড় হয়ে । কহি তোরে বীর ,

        কুন্তী আমি ।

কর্ণ ।              তুমি কুন্তী! অর্জুনজননী!

কুন্তী ।       অর্জুনজননী বটে! তাই মনে গণি

        দ্বেষ করিয়ো না বৎস । আজো মনে পড়ে

        অস্ত্রপরীক্ষার দিন হস্তিনানগরে

        তুমি ধীরে প্রবেশিলে তরুণ কুমার

        রঙ্গস্থলে , নক্ষত্রখচিত পূর্বাশার

        প্রান্তদেশে নবোদিত অরুণের মতো ।

        যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত

        তার মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী

        অতৃপ্ত স্নেহক্ষুধার সহস্র নাগিনী


        জাগায়ে জর্জর বক্ষে কাহার নয়ন

        তোমার সর্বাঙ্গে দিল আশিস্‌-চুম্বন ।

        অর্জুনজননী সে যে । যবে কৃপ আসি

        তোমারে পিতার নাম শুধালেন হাসি ,

        কহিলেন রাজকুলে জন্ম নহে যার

        অর্জুনের সাথে যুদ্ধে নাহি অধিকার

        আরক্ত আনত মুখে না রহিল বাণী ,

        দাঁড়ায়ে রহিলে , সেই লজ্জা-আভাখানি

        দহিল যাহার বক্ষ অগ্নিসম তেজে

        কে সে অভাগিনী । অর্জুনজননী সে যে ।

        পুত্র দুর্যোধন ধন্য , তখনি তোমারে

        অঙ্গরাজ্যে কৈল অভিষেক । ধন্য তারে ।

        মোর দুই নেত্র হতে অশ্রুবারিরাশি

        উদ্দেশে তোমারি শিরে উচ্ছ্বসিল আসি

        অভিষেক-সাথে । হেনকালে করি পথ

        রঙ্গমাঝে পশিলেন সূত অধিরথ

        আনন্দবিহ্বল । তখনি সে রাজসাজে

        চারি দিকে কুতূহলী জনতার মাঝে

        অভিষেকসিক্ত শির লুটায়ে চরণে

        সূতবৃদ্ধে প্রণমিলে পিতৃসম্ভাষণে ।

        ক্রূর হাস্যে পাণ্ডবের বন্ধুগণ সবে

        ধিক্কারিল ; সেইক্ষণে পরম গরবে

        বীর বলি যে তোমারে ওগো বীরমণি

        আশিসিল , আমি সেই অর্জুনজননী ।

কর্ণ ।       প্রণমি তোমারে আর্যে । রাজমাতা তুমি ,

        কেন হেথা একাকিনী । এ যে রণভূমি ,

        আমি কুরুসেনাপতি ।

কুন্তী ।                     পুত্র , ভিক্ষা আছে

        বিফল না ফিরি যেন ।

কর্ণ ।                     ভিক্ষা , মোর কাছে!

        আপন পৌরুষ ছাড়া , ধর্ম ছাড়া আর

        যাহা আজ্ঞা কর দিব চরণে তোমার ।


কুন্তী ।      এসেছি তোমারে নিতে ।

কর্ণ ।                     কোথা লবে মোরে!

কুন্তী ।      তৃষিত বক্ষের মাঝে লব মাতৃক্রোড়ে ।

কর্ণ ।       পঞ্চপুত্রে ধন্য তুমি , তুমি ভাগ্যবতী ,

        আমি কুলশীলহীন ক্ষুদ্র নরপতি

        মোরে কোথা দিবে স্থান ।

কুন্তী ।                     সর্ব-উচ্চভাগে

        তোমারে বসাব মোর সর্বপুত্র-আগে

        জ্যেষ্ঠ পুত্র তুমি ।

কর্ণ ।                কোন্‌ অধিকার-মদে

        প্রবেশ করিব সেথা । সাম্রাজ্যসম্পদে

        বঞ্চিত হয়েছে যারা মাতৃস্নেহধনে

        তাহাদের পূর্ণ অংশ খণ্ডিব কেমনে

        কহো মোরে । দ্যূতপণে না হয় বিক্রয় ,

        বাহুবলে নাহি হারে মাতার হৃদয়

        সে যে বিধাতার দান ।

কুন্তী ।                     পুত্র মোর , ওরে ,

        বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে

        এসেছিলি একদিন সেই অধিকারে

        আয় ফিরে সগৌরবে , আয় নির্বিচারে

        সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম

        লহো আপনার স্থান ।

কর্ণ ।                     শুনি স্বপ্নসম ,

        হে দেবী , তোমার বাণী । হেরো , অন্ধকার

        ব্যাপিয়াছে দিগ্‌বিদিকে , লুপ্ত চারি ধার

        শব্দহীনা ভাগীরথী । গেছ মোরে লয়ে

        কোন্‌ মায়াচ্ছন্ন লোকে , বিস্মৃত আলয়ে ,

        চেতনাপ্রত্যুষে । পুরাতন সত্যসম

        তব বাণী স্পর্শিতেছে মুগ্ধচিত্ত মম ।

        অস্ফুট শৈশবকাল যেন রে আমার ,

        যেন মোর জননীর গর্ভের আঁধার

        আমারে ঘেরিছে আজি । রাজমাতঃ অয়ি ,


        সত্য হোক , স্বপ্ন হোক , এসো স্নেহময়ী

        তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে

        রাখো ক্ষণকাল । শুনিয়াছি লোকমুখে

        জননীর পরিত্যক্ত আমি । কতবার

        হেরেছি নিশীথস্বপ্নে জননী আমার

        এসেছেন ধীরে ধীরে দেখিতে আমায় ,

        কাঁদিয়া কহেছি তাঁরে কাতর ব্যথায়

জননী , গুণ্ঠন খোলো , দেখি তব মুখ ' —

        অমনি মিলায় মূর্তি তৃষার্ত উৎসুক

        স্বপনেরে ছিন্ন করি । সেই স্বপ্ন আজি

        এসেছে কি পাণ্ডবজননীরূপে সাজি

        সন্ধ্যাকালে , রণক্ষেত্রে , ভাগীরথীতীরে ।

        হেরো দেবী , পরপারে পাণ্ডবশিবিরে

        জ্বলিয়াছে দীপালোক , এ পারে অদূরে

        কৌরবের মন্দুরায় লক্ষ অশ্বখুরে

        খর শব্দ উঠিছে বাজিয়া । কালি প্রাতে

        আরম্ভ হইবে মহারণ । আজ রাতে

        অর্জুনজননীকণ্ঠে কেন শুনিলাম

        আমার মাতার স্নেহস্বর । মোর নাম

        তাঁর মুখে কেন হেন মধুর সংগীতে

        উঠিল বাজিয়া চিত্ত মোর আচম্বিতে

        পঞ্চপাণ্ডবের পানে ভাই ' 'লে ধায় ।

কুন্তী ।      তবে চলে আয় বৎস , তবে চলে আয় ।

কর্ণ ।       যাব মাতঃ , চলে যাব , কিছু শুধাব না

        না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা ।

        দেবী , তুমি মোর মাতা! তোমার আহ্বানে

        অন্তরাত্মা জাগিয়াছে নাহি বাজে কানে

        যুদ্ধভেরী , জয়শঙ্খ মিথ্যা মনে হয়

        রণহিংসা , বীরখ্যাতি , জয়পরাজয় ।

        কোথা যাব , লয়ে চলো ।

কুন্তী ।                     ওই পরপারে

        যেথা জ্বলিতেছে দীপ স্তব্ধ স্কন্ধাবারে


        পাণ্ডুর বালুকাতটে ।

কর্ণ ।                     হোথা মাতৃহারা

        মা পাইবে চিরদিন! হোথা ধ্রুবতারা

        চিররাত্রি রবে জাগি সুন্দর উদার

        তোমার নয়নে! দেবী , কহো আরবার

        আমি পুত্র তব ।

কুন্তী ।                     পুত্র মোর!

কর্ণ ।                             কেন তবে

        আমারে ফেলিয়া দিলে দূরে অগৌরবে

        কুলশীলমানহীন মাতৃনেত্রহীন

        অন্ধ এ অজ্ঞাত বিশ্বে । কেন চিরদিন

        ভাসাইয়া দিলে মোরে অবজ্ঞার স্রোতে

        কেন দিলে নির্বাসন ভ্রাতৃকুল হতে ।

        রাখিলে বিচ্ছিন্ন করি অর্জুনে আমারে

        তাই শিশুকাল হতে টানিছে দোঁহারে

        নিগূঢ় অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে

        দুর্নিবার আকর্ষণে । মাতঃ , নিরুত্তর ?

        লজ্জা তব ভেদ করি অন্ধকার স্তর

        পরশ করিছে মোরে সর্বাঙ্গে নীরবে

        মুদিয়া দিতেছে চক্ষু । থাক্‌ , থাক্‌ তবে

        কহিয়ো না কেন তুমি ত্যজিলে আমারে ।

        বিধির প্রথম দান এ বিশ্বসংসারে

        মাতৃস্নেহ , কেন সেই দেবতার ধন

        আপন সন্তান হতে করিলে হরণ

        সে কথার দিয়ো না উত্তর । কহো মোরে

        আজি কেন ফিরাইতে আসিয়াছ ক্রোড়ে ।

কুন্তী ।      হে বৎস , ভর্ৎসনা তোর শতবজ্রসম

        বিদীর্ণ করিয়া দিক এ হৃদয় মম

        শত খণ্ড করি । ত্যাগ করেছিনু তোরে

        সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে ক'রে

        তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন তবু হায় ,

        তোরি লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মোর ধায় ,


        খুঁজিয়া বেড়ায় তোরে । বঞ্চিত যে ছেলে

        তারি তরে চিত্ত মোর দীপ্ত দীপ জ্বেলে

        আপনারে দগ্ধ করি করিছে আরতি

        বিশ্বদেবতার । আমি আজি ভাগ্যবতী ,

        পেয়েছি তোমার দেখা । যবে মুখে তোর

        একটি ফুটে নি বাণী তখন কঠোর

        অপরাধ করিয়াছি বৎস , সেই মুখে

        ক্ষমা কর্ কুমাতায় । সেই ক্ষমা বুকে

        ভর্ৎসনার চেয়ে তেজে জ্বালুক অনল ,

        পাপ দগ্ধ ক'রে মোরে করুক নির্মল ।

কর্ণ ।       মাতঃ , দেহো পদধূলি , দেহো পদধূলি

        লহো অশ্রু মোর ।

কুন্তী ।                    তোরে লব বক্ষে তুলি

        সে সুখ-আশায় পুত্র আসি নাই দ্বারে ।

        ফিরাতে এসেছি তোরে নিজ অধিকারে ।

        সূতপুত্র নহ তুমি , রাজার সন্তান

        দূর করি দিয়া বৎস , সর্ব অপমান

        এসো চলি যেথা আছে তব পঞ্চ ভ্রাতা ।

কর্ণ ।       মাতঃ , সূতপুত্র আমি , রাধা মোর মাতা ,

        তার চেয়ে নাহি মোর অধিক গৌরব ।

        পাণ্ডব পাণ্ডব থাক্‌ , কৌরব কৌরব

        ঈর্ষা নাহি করি কারে ।

কুন্তী ।                     রাজ্য আপনার

        বাহুবলে করি লহো , হে বৎস , উদ্ধার ।

        দুলাবেন ধবল ব্যজন যুধিষ্ঠির ,

        ভীম ধরিবেন ছত্র , ধনঞ্জয় বীর

        সারথি হবেন রথে , ধৌম্য পুরোহিত

        গাহিবেন বেদমন্ত্র তুমি শত্রুজিৎ

        অখণ্ড প্রতাপে রবে বান্ধবের সনে

        নিঃসপত্ন রাজ্যমাঝে রত্নসিংহাসনে ।

কর্ণ ।       সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহ পাশ

        তাহারে দিতেছ , মাতঃ , রাজ্যের আশ্বাস ।


        একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত

        সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত ।

        মাতা মোর , ভ্রাতা মোর , মোর রাজকুল

        এক মুহূর্তেই মাতঃ , করেছ নির্মূল

        মোর জন্মক্ষণে । সূতজননীরে ছলি

        আজ যদি রাজজননীরে মাতা বলি ,

        কুরুপতি কাছে বদ্ধ আছি যে বন্ধনে

        ছিন্ন ক'রে ধাই যদি রাজসিংহাসনে ,

        তবে ধিক্‌ মোরে ।

কুন্তী ।                     বীর তুমি , পুত্র মোর ,

        ধন্য তুমি । হায় ধর্ম , এ কী সুকঠোর

        দণ্ড তব । সেইদিন কে জানিত হায় ,

        ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়

        সে কখন বলবীর্য লভি কোথা হতে

        ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে ,

        আপনার জননীর কোলের সন্তানে

        আপন নির্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে ।

        এ কী অভিশাপ!

কর্ণ ।                          মাতঃ , করিয়ো না ভয় ।

        কহিলাম , পাণ্ডবের হইবে বিজয় ।

        আজি এই রজনীর তিমিরফলকে

        প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ নক্ষত্র-আলোকে

        ঘোর যুদ্ধ-ফল । এই শান্ত স্তব্ধ ক্ষণে

        অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে

        জয়হীন চেষ্টার সংগীত , আশাহীন

        কর্মের উদ্যম হেরিতেছি শান্তিময়

        শূন্য পরিণাম । যে পক্ষের পরাজয়

        সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান ।

        জয়ী হোক , রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান

        আমি রব নিষ্ফলের , হতাশের দলে ।

        জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে

        নামহীন , গৃহহীন আজিও তেমনি


        আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো জননী

        দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব- ' পরে ।

        শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে

        জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে , অয়ি ,

        বীরের সদ্‌গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই ।

=========================
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন